ভাবনার গল্প

- রাইটার... ও রাইটার, থামেন।
মৃদু কম্পাংকের মেয়েলী মিষ্টি অনুরোধ আমার দুই কান ঘেঁষে সামনের দিকে চলে গেল। যে লোকটিকে সামনে দেখছি তাঁকে লেখক বলে মনে হচ্ছে না। লেখকদের কাঁধে কাপড়ের জুলন্ত ব্যাগ থাকে। ডায়েরি বের করে লেখকরা চোখে চশমা রেখে নানা গল্প আঁটেন। কালো ফ্রেমের চশমা লেখকদের পুরোদমে উদ্ভাসিত করে। অথচ সামনের লোকটির মধ্যে লেখকের কোন আলামত নেই। আজকাল লেবাস দেখে মানুষের পেশা সনাক্ত করা নিতান্ত কঠিন কাজ। মেডিকেলে পড়াশোনা করে ব্যাংকার হয়ে যাওয়া লোকটাকে দেখলে কখনও মনে হয় না উনি ডাক্তার! সন্ধ্যায় তিনি চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। কিংবা ডিসি অফিসের ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে দেখলে টেরই মেলেনা তিনি যে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার! ইঞ্জিনিয়ারদের সাফারি পরার কথা অথচ তিনি পরেন সাদা সার্ট, কালো স্যুট আর লাল রংয়ের টাঁই। সৃজনশীল মানুষগুলো নিজের চরিত্রে ভিন্নতা রাখে কেন, কে জানে...?
.
সঙ্গত কারনে আমি পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। দেখতে নীতুর মত লাগে। গায়ে ধবধবে সাদা শাড়ি। সাদা শাড়ি পরলে মেয়েদের সিঙ্গেল মনে হয়। স্বামী হারানো মহিলা আর প্রেমে না পড়া মেয়ে- এরা দুই প্রকৃতির সিঙ্গেল বলা যায়। নীতুর সিঙ্গেল হওয়াটা অদ্ভুত ছিল! ইয়াদের কারনে নীতুকে ১ম টাইপের সিঙ্গেল হতে হয়েছে। ইয়াদ হচ্ছে হিমু উপন্যাসে হিমালয়ের বন্ধু, নীতুর স্বামী। পিএইচডি গবেষণার কাজে নীতুকে ছেড়ে ইয়াদ ভিক্ষুকদের দলে লাপাত্তা হয়েছিল। অদ্ভুত ঐ আইডিয়ার উদ্ভাবক ছিল হিমালয় ওরপে হিমু। নীতু মাঝেমাঝে রাতে সাদা শাড়ি পরে বারান্দায় বসে। নীতু আর মেয়েটির মধ্যে প্রার্থক্য হলো মেয়েটির গায়ে বেগুনী ব্লাউজ, নীতুর ব্লাউজ নীল রঙ্গের।
.
মেয়েটি আমার কাছাকাছি এসে আমতা আমতা করে বললো- আপনি সেই রাইটার নাবিল ? আমি বললাম, হ্যাঁ। এবারের একুশে বই মেলায় আপনার একটি বই এসেছে, বইটি আমি কিনবো। কিন্তু আপনার অটোগ্রাফ ছাড়া কিনবো না। চলেন প্রলয় প্রকাশনীতে যাই। আমি বললাম, বইটির সব কপি বিক্রয় হয়ে গেছে, সরি। এরকম জবাব দেওয়ার পর সব পাঠকরা একটা কমন প্রশ্ন করে, কত কপি বিক্রি হয়েছে? মেয়েটিও প্রশ্নটা করলো। বড় লেখকদের মত আমিও বললাম- এটা প্রকাশক জানেন।
.
লেখকের ভান ধরা, বই শেষ হওয়া কিংবা বিক্রিত বইয়ের সংখ্যার হিসাব প্রকাশকের উপর চাপিয়ে দেয়া সবগুলো ছিল মিথ্যে সিনক্রিয়েট। মেয়েটিকে যদি বলি আমি ভাই লেখক না, তাহলে সে হয়তো লজ্জা পাবে। মেয়েদেরকে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করলে দৌড় দেয়। আমি তার প্রস্থান চাচ্ছি না। শ্যাম বর্ণের মেয়েদের সাদা শাড়িতে যে অদ্ভুত সুন্দর লাগে কাছাকাছি থেকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
.
রাত এগারোটা হবে। সেলফোনে রিং হচ্ছে... অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনা গেল, রাইটার, আমি বিথি। আমি বললাম- কোন বিথি? ঐ যে, দিনে কথা হয়েছে আমি সেই বিথি। দিনের বিথি রাতে এতো মিষ্টি করে কথা বলে কিভাবে? আমার প্রশ্ন শুনে বিথি হিহি করে হাসছে। রাইটার, আগামীকাল সান ক্যাফেতে আসতে পারবেন, কথা আছে। বিথিকে না বলতে পারিনি। পরের দিন সন্ধ্যায় আমি সান ক্যাফেতে বিথির সামনে চিন্তিত ভাব নিয়ে বসে আছি। গতকাল বইমেলায় বিথিকে যে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম তা মাথা কাত করে দেখছে। তার চোখের চাহনি সন্দেহপ্রবন।
- রাইটার গতকাল মিথ্যা বললেন কেন?
- মানে? কি মিথ্যা বললাম?
- আপনি বললেন আপনার লেখা বইটি শেষ হয়ে গেছে। স্টলে তো বইটি ছিল। কেন মিথ্যা বললেন?
আমার আমতা আমতা করা দেখে বিথি সামনে রাখা পেপের জুস আমার মুখে ছুড়ে মারলো। সক্রেটিসের বান্ধবী সক্রেটিসের আচরণ সহ্য করতে না পেরে পানি ছুড়ে মারতেন। বিথি এমন করলো কেন? আমি টিস্যু দিয়ে ভেজা মুখ পরিস্কার করার চেষ্টা করছি। হটাৎ ভূমিকম্পের মত হালকা ঝাকুনী লাগলো। চোখ খুলে দেখি বাসের জানালার পাশে বসা। কখন ঘুম লেগে যায় খেয়াল করিনি। ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি হয় জানতাম না। জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে বৃষ্টি পানি বাসের ভেতরে ডোকে মুখ ভিজিয়ে দিলো। ম্যানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে এক কোনায় ধরে চেয়ে আছি। শনিবার অধ্যক্ষ বিশেষ কারনে মিটিং ডেকেছেন। গনিতের লেকচারার হিসেবে আমার পার্টিসিপেন্ট করাটা জরুরী। লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাসের জানালা বন্ধ করে সিটে মাথা হেলান দিলাম। বাস চলছে....
.
মিজানুর রহমান
০৩.০৩.২০১৭

No comments:

Post a Comment