- বুঝলেন সাহেদ, এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। আর ঐ যে দেখছেন ব্রীজটা, এটা সিলেটকে হাইলাইট করে আর এইটা হলো আলী আমজাদের ঘড়ি। সুন্দর না?
.
দীর্ঘ স্বরের 'হুম' শব্দ শুনে আমি ফিরে তাকাতেই দেখি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক। দাঁড়ি কৃষ্ণকায় বর্ণের। দেখলেই মনে হয় বয়স ২৭-২৮ হবে। করমর্দনের জন্য আমার দিকে এগিয়ে এসে পাঞ্জাবি পরা লোকটি বললেন- 'আমি সাহেদ। যদি ভুল না করি তবে আপনি নাবিল, তাইতো? প্রীতির মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।' আমি হাত না ছেড়ে প্রীতি নামের মেয়েটির দিকে একবার আর পাঞ্জাবি পরা লোকটির দিকে একবার এভাবে তাকাচ্ছি। প্রীতিই তো! হাত ছেড়ে আমার সেই বিখ্যাত ঠোঁট টিপা হাসি দিয়ে বললাম-
- জ্বী আমি নাবিল। বসেন সাহেদ সাহেব।
.
- ওকে। তবে আমি বসবো না। প্রীতি তুমি বসো। আমি হেঁটে ওদিকটা একটু দেখি।
.
একজন হুজুর টাইপের লোক অথচ নিজের স্ত্রীকে আমার পাশে রেখে একা হাটছেন...। আমি প্রীতির পাশে শহরের জিরো পয়েন্টে চায়ের দোকানে বসে আছি। নদীর পাড়ের হিমেল বাতাস আর মাঝারি ঢেউয়ের কলকল শব্দ শুনে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। দীর্ঘ চার বছর পর প্রীতির সাথে আবার দেখা হবে বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কয়েকদিনে প্রীতি অনেক বদলে গেছে। আমি যে প্রীতিকে চিনি তার আগুন রঙ্গা ঠোঁটের নিচে ছিল একটি কালো তিল আর চেহারা ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা। খোপা খোলা চুল ছিল। অথচ এই প্রীতির তিল নেই, চেহারাও বেশ ফর্সা, হিজাব করা। মেকআপ করেছে কিনা কে জানে! আমাদের বাসা ছিল একই ফ্লাটে। প্রীতির বাবা আমাদের ভার্সিটির ভিসি ছিলেন। প্রীতি আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। সেই সূত্রে প্রীতির সাথে পরিচয়। চায়ের কাপ রেখে আমি প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললাম-
- বুঝলে প্রীতি, এই যান্ত্রিক শহরে স্রেফ একা থাকা খুব কঠিন। চাইলেই তুমি একা থাকতে পারবে না।
.
- হুম। শুনলাম বিয়ে করেছো। সংসার নিয়ে ভালই আছো, তোমার কথা বলার ধরন দেখে তাইতো মনে হচ্ছে।
.
- ভালই কথা শিখেছো। প্রীতি, সাহেদ সাহেবকে আমার বিষয়ে কি গল্প করেছো, একটু কি বলবে....?
.
- নাক চেপ্টা বেটা, তুমি এমন বিখ্যাত কেউ না যে তোমার কথা গল্প করবো। গল্পটল্প করিনি। বিয়ের রাতের তোমার ঘটানো কান্ডটা স্যায়ার করেছি।
.
সেদিন ছিল ২২ শে শ্রাবণ। প্রীতির বিয়ের আগের রাত। এতোক্ষনে গায়ে হলুদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমি রুমে বসে আছি। প্রীতি বারবার ফোন করছে। আমি কল ধরছি না। এই প্রথম প্রীতির জন্য শূণ্যতা অনুভব করছি। এই শূণ্যতা প্রীতির জানার অধিকার নেই। আমি যদি গায়েহলুদে না যাই প্রীতি রুমে এসে খুঁজবে। প্রীতির পাশে দাড়ানোর শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি কাউকে না বলে কিছু কাপড় আর বই নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রাতটা রাফির বাসায় কাটাবো। রাফির বাসায় আসার পর দেখি ডায়েরি আনিনি। সম্ভবতঃ পড়ার টেবিলে রেখে এসেছি। মনে আছে, শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম- প্রীতি নামের মেয়েরা এতো চাপা স্বভাব হয় কেন?
.
ডায়েরি অথবা বিয়েতে না যাওয়া, কোনটি প্রীতির ভাষায় কান্ড... কে জানে? চোখের সামনে প্রীতির হাত নাড়ানোর কারনে আমার অবচেতন মন পুনরায় জাগ্রত হলো। আমি বললাম-
- কি যেন বলেছিলে?
.
- বলেছি বিয়েতে গেলে না কেন? অবশ্যই আমি খালেদকে বিয়ে করিনি :)। রাতে আমার এক বান্ধবী খালেদ যে ড্রাগ এডিকটেড ছিল এই বিষয়ে বাবাকে বেশ কিছু ভিডিও দেখিয়েছিল। এই কারনে বাবা বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন।
.
- মানে? তাহলে আসাদ সাহেব! কিছুই মাথায় যাচ্ছে না। ক্লিয়ার করো।
.
- উনি আমার বোনের স্বামী। তুমি আপার বিষয়ে কিছু জানো না?
.
- না।
.
- আপা গত বছর বাচ্চা প্রসবের সময় মারা গেছেন। আমার কোলের বেবিটা আপার। বউহারা বেচারা বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রামে বিপদে আছে। মানুষটার জন্য মায়া হয়। তাই ভাবলাম সিলেটে নিয়ে আসি। একটু ঘুরিয়ে দেখালে হয়তো ভাল লাগবে মানুষটার।
.
প্রীতি আমার ডানপাশে বেঞ্চে হাত ভর করে নীল আকাশ দেখছে। আমি পকেট থেকে কলম বের করে কুড়িয়ে নেয়া কাগজে বড় করে লিখলাম- "এই নাক চেপ্টা বেটার হাতের উপরে চাপা প্রীতির হাতটা রাখা যাবে?" আমি হাতটা প্রীতির পাশে রাখলাম। ফাঁকা স্থানে চিরকুট। আসাদ সাহেবও আমাদের দিকে ফিরে আসতেছেন। হটাৎ একটা ধমকা হাওয়া এসে চিরকুট উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি প্রীতির চোখের দিকে থাকালাম। আমার হৃদকম্পন বাড়তে লাগলো। আমি এই প্রথম রহস্যে ডুব দিলাম। আমার ভেতর প্রীতি নামে নতুন মৌন মিছিল আন্দোলিত হলো। আমি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। মানবিক বিস্ময় আমাকে ভাবাতে শুরু করলো। আসাদ সাহেব প্রীতিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি আনমনে প্রীতির প্রস্থান দেখছি... কানের কাছে এক অদৃশ্য শব্দ ফিসফিস করে বলতে লাগলো- প্রীতি আছে, প্রীতি থাকবে।
.
মিজানুর রহমান
০১.০৫.২০১৭
.
দীর্ঘ স্বরের 'হুম' শব্দ শুনে আমি ফিরে তাকাতেই দেখি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক। দাঁড়ি কৃষ্ণকায় বর্ণের। দেখলেই মনে হয় বয়স ২৭-২৮ হবে। করমর্দনের জন্য আমার দিকে এগিয়ে এসে পাঞ্জাবি পরা লোকটি বললেন- 'আমি সাহেদ। যদি ভুল না করি তবে আপনি নাবিল, তাইতো? প্রীতির মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।' আমি হাত না ছেড়ে প্রীতি নামের মেয়েটির দিকে একবার আর পাঞ্জাবি পরা লোকটির দিকে একবার এভাবে তাকাচ্ছি। প্রীতিই তো! হাত ছেড়ে আমার সেই বিখ্যাত ঠোঁট টিপা হাসি দিয়ে বললাম-
- জ্বী আমি নাবিল। বসেন সাহেদ সাহেব।
.
- ওকে। তবে আমি বসবো না। প্রীতি তুমি বসো। আমি হেঁটে ওদিকটা একটু দেখি।
.
একজন হুজুর টাইপের লোক অথচ নিজের স্ত্রীকে আমার পাশে রেখে একা হাটছেন...। আমি প্রীতির পাশে শহরের জিরো পয়েন্টে চায়ের দোকানে বসে আছি। নদীর পাড়ের হিমেল বাতাস আর মাঝারি ঢেউয়ের কলকল শব্দ শুনে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। দীর্ঘ চার বছর পর প্রীতির সাথে আবার দেখা হবে বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কয়েকদিনে প্রীতি অনেক বদলে গেছে। আমি যে প্রীতিকে চিনি তার আগুন রঙ্গা ঠোঁটের নিচে ছিল একটি কালো তিল আর চেহারা ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা। খোপা খোলা চুল ছিল। অথচ এই প্রীতির তিল নেই, চেহারাও বেশ ফর্সা, হিজাব করা। মেকআপ করেছে কিনা কে জানে! আমাদের বাসা ছিল একই ফ্লাটে। প্রীতির বাবা আমাদের ভার্সিটির ভিসি ছিলেন। প্রীতি আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। সেই সূত্রে প্রীতির সাথে পরিচয়। চায়ের কাপ রেখে আমি প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললাম-
- বুঝলে প্রীতি, এই যান্ত্রিক শহরে স্রেফ একা থাকা খুব কঠিন। চাইলেই তুমি একা থাকতে পারবে না।
.
- হুম। শুনলাম বিয়ে করেছো। সংসার নিয়ে ভালই আছো, তোমার কথা বলার ধরন দেখে তাইতো মনে হচ্ছে।
.
- ভালই কথা শিখেছো। প্রীতি, সাহেদ সাহেবকে আমার বিষয়ে কি গল্প করেছো, একটু কি বলবে....?
.
- নাক চেপ্টা বেটা, তুমি এমন বিখ্যাত কেউ না যে তোমার কথা গল্প করবো। গল্পটল্প করিনি। বিয়ের রাতের তোমার ঘটানো কান্ডটা স্যায়ার করেছি।
.
সেদিন ছিল ২২ শে শ্রাবণ। প্রীতির বিয়ের আগের রাত। এতোক্ষনে গায়ে হলুদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমি রুমে বসে আছি। প্রীতি বারবার ফোন করছে। আমি কল ধরছি না। এই প্রথম প্রীতির জন্য শূণ্যতা অনুভব করছি। এই শূণ্যতা প্রীতির জানার অধিকার নেই। আমি যদি গায়েহলুদে না যাই প্রীতি রুমে এসে খুঁজবে। প্রীতির পাশে দাড়ানোর শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি কাউকে না বলে কিছু কাপড় আর বই নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রাতটা রাফির বাসায় কাটাবো। রাফির বাসায় আসার পর দেখি ডায়েরি আনিনি। সম্ভবতঃ পড়ার টেবিলে রেখে এসেছি। মনে আছে, শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম- প্রীতি নামের মেয়েরা এতো চাপা স্বভাব হয় কেন?
.
ডায়েরি অথবা বিয়েতে না যাওয়া, কোনটি প্রীতির ভাষায় কান্ড... কে জানে? চোখের সামনে প্রীতির হাত নাড়ানোর কারনে আমার অবচেতন মন পুনরায় জাগ্রত হলো। আমি বললাম-
- কি যেন বলেছিলে?
.
- বলেছি বিয়েতে গেলে না কেন? অবশ্যই আমি খালেদকে বিয়ে করিনি :)। রাতে আমার এক বান্ধবী খালেদ যে ড্রাগ এডিকটেড ছিল এই বিষয়ে বাবাকে বেশ কিছু ভিডিও দেখিয়েছিল। এই কারনে বাবা বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন।
.
- মানে? তাহলে আসাদ সাহেব! কিছুই মাথায় যাচ্ছে না। ক্লিয়ার করো।
.
- উনি আমার বোনের স্বামী। তুমি আপার বিষয়ে কিছু জানো না?
.
- না।
.
- আপা গত বছর বাচ্চা প্রসবের সময় মারা গেছেন। আমার কোলের বেবিটা আপার। বউহারা বেচারা বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রামে বিপদে আছে। মানুষটার জন্য মায়া হয়। তাই ভাবলাম সিলেটে নিয়ে আসি। একটু ঘুরিয়ে দেখালে হয়তো ভাল লাগবে মানুষটার।
.
প্রীতি আমার ডানপাশে বেঞ্চে হাত ভর করে নীল আকাশ দেখছে। আমি পকেট থেকে কলম বের করে কুড়িয়ে নেয়া কাগজে বড় করে লিখলাম- "এই নাক চেপ্টা বেটার হাতের উপরে চাপা প্রীতির হাতটা রাখা যাবে?" আমি হাতটা প্রীতির পাশে রাখলাম। ফাঁকা স্থানে চিরকুট। আসাদ সাহেবও আমাদের দিকে ফিরে আসতেছেন। হটাৎ একটা ধমকা হাওয়া এসে চিরকুট উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি প্রীতির চোখের দিকে থাকালাম। আমার হৃদকম্পন বাড়তে লাগলো। আমি এই প্রথম রহস্যে ডুব দিলাম। আমার ভেতর প্রীতি নামে নতুন মৌন মিছিল আন্দোলিত হলো। আমি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। মানবিক বিস্ময় আমাকে ভাবাতে শুরু করলো। আসাদ সাহেব প্রীতিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি আনমনে প্রীতির প্রস্থান দেখছি... কানের কাছে এক অদৃশ্য শব্দ ফিসফিস করে বলতে লাগলো- প্রীতি আছে, প্রীতি থাকবে।
.
মিজানুর রহমান
০১.০৫.২০১৭
No comments:
Post a Comment