একটি মূল্যবোধের গল্প

গেল বিজয় দিবসের ঘটনা। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে আমি সালাম গ্রহণ মঞ্চের পেছনে দাড়িয়ে ছিলাম। ততক্ষণে পতাকা উত্তোলণসহ কুচকাওয়াজের মত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ডিসপ্লে প্রদশর্নী, খেলাধুলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে। সালাম গ্রহণ মঞ্চে যারা ছিলেন তারাও নেমে গেছেন। আমি তখনও দাড়িয়ে আছি। ঐ অবস্থান থেকে ভালোভাবে মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে দেখা যাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু পরিবার খুব ভাল পারফর্ম করছে সেটা দেখছি। হটাৎ কয়েকটি গলার আওয়াজ শুনে মনোযোগ সালাম গ্রহণ মঞের দিকে গেল। একটি শিশু মঞ্চের সামনের অংশে ঠিক মাঝামাঝি বসে পা ঝুলাচ্ছে। মঞ্চটি একটু উচু হওয়ায় দূর্ঘটনা এড়াতে আমরা কয়েকজন ছেলেটি নামানোর জন্য তার কাছে গেলাম। কোনভাবেই তাকে নামাতে পারছি না। সে নামতে চায় না। এক পর্যায়ে বললাম- বাবু, এখানে থেকে তোমার লাভ কি, নেমে যাও, বিপদ হতে পারে। ছেলেটির চেহারায় বিরক্তের আবহ লক্ষ করলাম। আবারও বললাম- বাবু নেমে যাও। আমার হাতটাসহ আমাকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে উচ্চ স্বরে বললো- আমার বাবা Rank পাইছে, আমার এখানেই বসা ঠিক আছে। আমি এখানেই বসবো। আমরা স্তব্দ হয়ে গেলাম। পেশীর সব শক্তি হারিয়ে ফেললাম। বাবুটা সামনে বসে আছে আর আমি পেছনে দাড়ানো। নৈতিক অধঃপতন!
.
গল্পটি আজ স্যায়ার করছি বিভিন্ন কারনে। মাতৃগর্ভে জন্ম নিলেই একটি শিশু মানুষ হয়ে ওঠে না, মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় পরিবার। শিশু যা দেখে তাই শেখে আর এভাবে শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এই জায়গায় পরিবারের বাবা-মায়েরা কতটুকু দায়িত্ব নেয় তা নিজের মধ্যে সংশয়ের উদ্ভব হয়। কথাটা বলার পেছনে কারন আছে। যে ছেলে বাবার Rank পাওয়া নিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করে সে পরিবার থেকে কি শিখেছে বলা বাহুল্য। সে যদি জানতো, তার বাবা আততায়ীর হাতে খুন হওয়া এক সন্তানের পিতার সার্বিক নিরাপত্তাসহ আসল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার সাফল্যের জন্য এই Rank বা প্রমোশন পেয়েছেন। তার ভেতর এক ধরনের মূল্যবোধ জাগ্রত হতো। এই মূল্যবোধ বিকৃতির দায় শিশুর চেয়ে তার পরিবারের বেশী। মা বাবা দুই দপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্ব স্ব দপ্তরে সর্বোচ্চটা দেওয়াতে যখন তারা মগ্ন, ছেলের লালন পালনের দায়িত্ব পড়ে অশিক্ষিত গৃহকর্মীর হাতে। স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে বাবার মত সামনের চেয়ারে বসবে, সবাই প্রটোকল দিবে, তোষামোদ করবে। সাধারন মানুষের জীবন সম্পর্কে সে জানেনা, দরিদ্রের দুর্দশা কখনও সে দেখেনি। পারিবারিক মূল্যবোধ সে পায়নি। দেশপ্রেম সম্পর্কে তাকে কেউ উদ্বুদ্ধ করেনি। পারিবারিক বন্ধন থেকে সে বঞ্চিত। দিন শেষে অফিসটাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাসায়। সে অফিসকে জানে, বাবার Rank কে জানে, বড় হয়ে বাবার মত ক্ষমতাধর হওয়ার প্রেষণা শুনে। বিভিন্ন উপলক্ষতে সামনে চেয়ারে বসে, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সে ডুব দেয় বড় হওয়ার সমুদ্রে। মানবতা, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অধঃপতন হয় তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে। সময়ের কারনে তিনি দাড়িয়ে থাকবেন সালাম গ্রহণ মঞ্চে আর আমি থাকবো পেছনে... অনেক পেছনে।
.
মিজানুর রহমান
২১.০১.২০১৭ খ্রি.

No comments:

Post a Comment