স্বীকৃতি

মেয়ে, দেশ দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির কবলে পড়েছে। লোক মারফত জেনেছি, মানুষ নাকি অবসরে থাকলে অপচয় করে! আমিও এই ছুটিতে শব্দ অপচয় করবো :) । কিবোর্ড আমার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হবে, সাথে তুমিও।
.
শুনো, তোমার সঙ্গোপনে নিজেকে বাচাল বানানো আমার নিজের সৃষ্ট চরিত্র। কেননা আমি চাই আমার বেস্টনির কথার ফুলঝুড়িতে তুমি ভাল থাকো। গ্লাণিহীন পথে তোমার অভিযাত্রিক হওয়া একজন পুরুষের পক্ষে তা রথযাত্রা। তোমার সান্নিধ্য নিশ্চিত করতে আমিতো পুরুষ হতে চাইনি, প্রেমিক হওয়ার সম্ভাবনায় মাটির বুকে হাঁটু গেড়ে হাত বাড়িয়েছি কতবার!
.
বলো মেয়ে, আমি কি প্রেমিক হতে পেরেছি? নির্বাক, তুমি কি ভাবছো? ভাবছো হয়তো রক্ত মাংসের গন্ধে আমি প্রেমাতাল! আমার বর্জিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডে কি এরকম আভাস পাচ্ছো? আমার মাঝে পুরুষালীর অস্তিত্ব সন্ধান করতে গিয়ে তোমার চেহারায় যে অনিরাপত্তার ছাপ পড়েছে তাতে আমি শংকিত, কঠিন শংকিত।
.
শুনো মেয়ে, মেয়েরা খুব আজব জীব, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। আমাকে পুরুষ ভেবে তোমার সরে যাওয়াটা বোকামি। আমি তোমার জন্য পুরুষ হতে চাইনি। আমি প্রেমিক হতে চেয়েছি। পুরুষদের যা থাকে প্রেমিকের সেটা নেই। এই যেমন, সবুজ রঙ্গের শাড়ি গায়ে তোমার সাথে আমার বৃষ্টি ভেঁজার স্বপ্ন আছে অথচ প্রেমিকের ছাদ নেই। পুরুষের বহুতল ভবন আছে কিন্তু প্রেম নেই।
.
বলো, আমি কখনও তোমার মাঝে সুনীলের বরুনাকে খুঁজেছি? সুনীল বরুনার বুকে রক্ত মাংসের গন্ধ পেয়েছিল। বাঙালী নাকি উৎসুক, আবেগে টালমাটাল। তার মানে আমিও আবেগী। আবেগী পুরুষরা কবি হতে চায়, আমিও কবি হতে চাই! প্রেমিক কবি।
.
মেয়েরা নাকি সঙ্গী ছাড়া চলতে পারেনা! এজন্যই কাগজ কলমে বাবারা হয়তো মেয়েদের সঙ্গী ধরিয়ে দেন। বিয়ের পর সিংহভাগ মেয়ে পুরুষের সান্নিধ্য পায়, প্রেমিকের নয়। বিবাহিত পুরুষের অস্তিত্ব একটা দশা যাওয়ার পর বিলীন হয়ে যাবে। প্রেমিকের অস্তিত্ব আজীবন।
.
প্লিজ, মাটির বুকে হাঁটু গাড়া ছেলের হাত ধরে টান দাও। আমাকে প্রেমিকের স্বীকৃতি দাও। :P
.
মিজানুর রহমান
০৮.০৬.২০১৭

ভাবনার গল্প

- রাইটার... ও রাইটার, থামেন।
মৃদু কম্পাংকের মেয়েলী মিষ্টি অনুরোধ আমার দুই কান ঘেঁষে সামনের দিকে চলে গেল। যে লোকটিকে সামনে দেখছি তাঁকে লেখক বলে মনে হচ্ছে না। লেখকদের কাঁধে কাপড়ের জুলন্ত ব্যাগ থাকে। ডায়েরি বের করে লেখকরা চোখে চশমা রেখে নানা গল্প আঁটেন। কালো ফ্রেমের চশমা লেখকদের পুরোদমে উদ্ভাসিত করে। অথচ সামনের লোকটির মধ্যে লেখকের কোন আলামত নেই। আজকাল লেবাস দেখে মানুষের পেশা সনাক্ত করা নিতান্ত কঠিন কাজ। মেডিকেলে পড়াশোনা করে ব্যাংকার হয়ে যাওয়া লোকটাকে দেখলে কখনও মনে হয় না উনি ডাক্তার! সন্ধ্যায় তিনি চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। কিংবা ডিসি অফিসের ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে দেখলে টেরই মেলেনা তিনি যে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার! ইঞ্জিনিয়ারদের সাফারি পরার কথা অথচ তিনি পরেন সাদা সার্ট, কালো স্যুট আর লাল রংয়ের টাঁই। সৃজনশীল মানুষগুলো নিজের চরিত্রে ভিন্নতা রাখে কেন, কে জানে...?
.
সঙ্গত কারনে আমি পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে। দেখতে নীতুর মত লাগে। গায়ে ধবধবে সাদা শাড়ি। সাদা শাড়ি পরলে মেয়েদের সিঙ্গেল মনে হয়। স্বামী হারানো মহিলা আর প্রেমে না পড়া মেয়ে- এরা দুই প্রকৃতির সিঙ্গেল বলা যায়। নীতুর সিঙ্গেল হওয়াটা অদ্ভুত ছিল! ইয়াদের কারনে নীতুকে ১ম টাইপের সিঙ্গেল হতে হয়েছে। ইয়াদ হচ্ছে হিমু উপন্যাসে হিমালয়ের বন্ধু, নীতুর স্বামী। পিএইচডি গবেষণার কাজে নীতুকে ছেড়ে ইয়াদ ভিক্ষুকদের দলে লাপাত্তা হয়েছিল। অদ্ভুত ঐ আইডিয়ার উদ্ভাবক ছিল হিমালয় ওরপে হিমু। নীতু মাঝেমাঝে রাতে সাদা শাড়ি পরে বারান্দায় বসে। নীতু আর মেয়েটির মধ্যে প্রার্থক্য হলো মেয়েটির গায়ে বেগুনী ব্লাউজ, নীতুর ব্লাউজ নীল রঙ্গের।
.
মেয়েটি আমার কাছাকাছি এসে আমতা আমতা করে বললো- আপনি সেই রাইটার নাবিল ? আমি বললাম, হ্যাঁ। এবারের একুশে বই মেলায় আপনার একটি বই এসেছে, বইটি আমি কিনবো। কিন্তু আপনার অটোগ্রাফ ছাড়া কিনবো না। চলেন প্রলয় প্রকাশনীতে যাই। আমি বললাম, বইটির সব কপি বিক্রয় হয়ে গেছে, সরি। এরকম জবাব দেওয়ার পর সব পাঠকরা একটা কমন প্রশ্ন করে, কত কপি বিক্রি হয়েছে? মেয়েটিও প্রশ্নটা করলো। বড় লেখকদের মত আমিও বললাম- এটা প্রকাশক জানেন।
.
লেখকের ভান ধরা, বই শেষ হওয়া কিংবা বিক্রিত বইয়ের সংখ্যার হিসাব প্রকাশকের উপর চাপিয়ে দেয়া সবগুলো ছিল মিথ্যে সিনক্রিয়েট। মেয়েটিকে যদি বলি আমি ভাই লেখক না, তাহলে সে হয়তো লজ্জা পাবে। মেয়েদেরকে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করলে দৌড় দেয়। আমি তার প্রস্থান চাচ্ছি না। শ্যাম বর্ণের মেয়েদের সাদা শাড়িতে যে অদ্ভুত সুন্দর লাগে কাছাকাছি থেকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
.
রাত এগারোটা হবে। সেলফোনে রিং হচ্ছে... অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনা গেল, রাইটার, আমি বিথি। আমি বললাম- কোন বিথি? ঐ যে, দিনে কথা হয়েছে আমি সেই বিথি। দিনের বিথি রাতে এতো মিষ্টি করে কথা বলে কিভাবে? আমার প্রশ্ন শুনে বিথি হিহি করে হাসছে। রাইটার, আগামীকাল সান ক্যাফেতে আসতে পারবেন, কথা আছে। বিথিকে না বলতে পারিনি। পরের দিন সন্ধ্যায় আমি সান ক্যাফেতে বিথির সামনে চিন্তিত ভাব নিয়ে বসে আছি। গতকাল বইমেলায় বিথিকে যে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম তা মাথা কাত করে দেখছে। তার চোখের চাহনি সন্দেহপ্রবন।
- রাইটার গতকাল মিথ্যা বললেন কেন?
- মানে? কি মিথ্যা বললাম?
- আপনি বললেন আপনার লেখা বইটি শেষ হয়ে গেছে। স্টলে তো বইটি ছিল। কেন মিথ্যা বললেন?
আমার আমতা আমতা করা দেখে বিথি সামনে রাখা পেপের জুস আমার মুখে ছুড়ে মারলো। সক্রেটিসের বান্ধবী সক্রেটিসের আচরণ সহ্য করতে না পেরে পানি ছুড়ে মারতেন। বিথি এমন করলো কেন? আমি টিস্যু দিয়ে ভেজা মুখ পরিস্কার করার চেষ্টা করছি। হটাৎ ভূমিকম্পের মত হালকা ঝাকুনী লাগলো। চোখ খুলে দেখি বাসের জানালার পাশে বসা। কখন ঘুম লেগে যায় খেয়াল করিনি। ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি হয় জানতাম না। জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে বৃষ্টি পানি বাসের ভেতরে ডোকে মুখ ভিজিয়ে দিলো। ম্যানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে এক কোনায় ধরে চেয়ে আছি। শনিবার অধ্যক্ষ বিশেষ কারনে মিটিং ডেকেছেন। গনিতের লেকচারার হিসেবে আমার পার্টিসিপেন্ট করাটা জরুরী। লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাসের জানালা বন্ধ করে সিটে মাথা হেলান দিলাম। বাস চলছে....
.
মিজানুর রহমান
০৩.০৩.২০১৭

আমি ও অপরিপক্ব গণনা

সিএনজি'র পেছনের সিটের পাশ ঘেঁষে বসে আছি। প্রচন্ড বেগে বাতাসে ঠান্ডা বইছে। হাত পা হিম শীতল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। মনে অদ্ভুত এক হিসাব ঘোরপাক করছে। হিসাবটা এরকম- ২৩ বছর বয়সী একজন যুবককে চাচ্ছি তেত্রিশ বছরে উন্নীত করতে। কেন চাচ্ছি জানিনা, মনে হচ্ছে করাটা দরকার। আবার ভয়ও হচ্ছে অনেক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তেত্রিশ বছরে কিছু পাননি দেখেই তো ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় অপূর্ণতা তুলে ধরেছেন। বরুনার দেওয়া সুগন্ধের বদলে সুনীল রক্ত মাংসের গন্ধ পেয়েছিলেন। এই গন্ধটা নিখাঁদ ছিল না। তারপরও তেত্রিশটা যে খুব দরকার।
.
সময়টা এখন পালা বদলের। মাঝে মধ্য মনে হয় কবি হয়ে গেলে ভালো হতো। কবিরা তো দন্ডিত অপুরুষ। আমিও দন্ডিত অপুরুষ হতে চাই। কিন্তু জীবনের হিসাবটা মেলাতে পারছি না। ইদানিং পরদেশী রমনীরা এখানে এসে নবীগঞ্জের রকিবদের বিয়ে করছে। আমি নিতান্ত অবাক হচ্ছি অহরহ। এই রকিবরা কি সেওমার মত পরদেশীদের কেন চাচ্ছে? অর্থের স্বার্থ নাকি সুনীলের গন্ধে বিমোহিত, কে জানে? পরদেশী মেয়েদের আমি রমনী বলিই বা কেন? রকিবরা তো তেত্রিশে আসেনি, তেত্রিশ বুঝেনি।
.
জীবনের হিসাবটা মেলাতে পারলাম না। না তেইশের, না তেত্রিশের। নিজের ২৩ তম জন্মদিন চলে যাচ্ছে আর আমি তেত্রিশ নিয়ে মগ্নে আছি। এই প্রথম ইচ্ছা করেই জন্মদিনটা হাইড রেখেছি । ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় জন্ম তারিখে প্রাইবেসি দিয়েছি। কারনটা অজানা। ঘন্টা দুয়েক পর জন্মদিনটা বাসি হয়ে যাবে। নতুন বছরের হিসাব আবার শুরু হবে। তেত্রিশ আসবে ঠিকই কিন্তু হিসাবে আমি অপরিপক্ক থেকে যাবো আজকের মত।
.
মিজানুর রহমান
৩০.০১.২০১৭

কল্পনার পরিবার এবং সুকন্যা

আকাশে মিটিমিটি চাঁদ। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা হবে। আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছি। চোখে ক্লান্তির তন্দ্রা অনুভব করছি ঠিক তখন মোবাইলে এসএমএস আসছে। লাভনী সম্ভবত এসএমএস করেছে। লাভনী প্রায়ই কারনে অকারনে এসএমএস করে। এসএমএস এর শব্দ শুনে সুকন্যা তড়িগড়ি করে এসে মোবাইল হাতে নিলো। আমি চোখ পুরোদমে বন্ধ করার চেষ্ঠা করছি তখন ধপ করে সুকন্যা মোবাইল আমার বুকের উপর ফেলে দিলো। অন্য মেয়ের সান্নিধ্য কোন স্ত্রীই সহ্য করতে পারেনা, সুকন্যার চেহারা এমনটা বলছে। ইদানিং সে আমার অফিস সম্পর্কে জানতে চায়। পাশের ডেস্কে কে বসে, পুরুষ না মহিলা? দেরি করে বাসা ফিরলে কৈফিয়ত চায়। আমি যদি সুকন্যাকে বলি লাভনী কোন মেয়ে নয়, একটি নামকরা মোবাইল অপারেটরের অফার পাঠানোর নম্বর। বিরক্ত হয় লাভনী (লাভ নাই) নামে সেভ করেছি। বিশ্বাস করবে? যদি বিশ্বাস করে তবে কি টেক কেয়ারের হার কমিয়ে দিবে? বাঙলী মেয়েরা যখন টের পায় স্বামী পর নারীতে আসক্ত, অবিশ্বাস্য টেক কেয়ার শুরু করে। সুকন্যাও তাই করছে....
.
২। ফেসবুকে আত্নহত্যার বিষয়টি নিয়ে সবাই খুব লেখালেখি শুরু করেছে। সুকন্যাকে নিয়েও শঙ্কায় আছি। তরুন এক লেখিকার আত্নহত্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় নিউজফিড আত্নহত্যার পক্ষে-বিপক্ষে সবাই সরব। সবার মন খারাপ। কেউ মজার কিছু লিখছে না। আমাকে মজার কিছুু লেখা উচিত -
কোন এক রাজ্যের রাজা আর রানী রাতের বেলা গল্প করার সময় এক মুহুর্তে রানী বলে ফেললেন, 'সব স্বামীরাই বউয়ের কথা শোনে।' রাজা রানীর কথায় একমত হলেন না । তারা একে অপরের সাথে তর্ক শুরু করলেন। এক পর্যায় রাজা রানীকে বললেন- 'ঠিক আছে, কালই প্রমাণ হয়ে যাবে কে কার কথা শোনে।' পরের দিন রাজ্যে ঘোষণা করা হল “সব বিবাহিত প্রজাদের জন্য রাজা এক বিশেষ পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন”। তখন সব বিবাহিত প্রজার হুড়োহুড়ি দিয়ে রাজপ্রসাদের সামনে হাজির হলো । রাজ দরবারের সামনে দুইটা সাইনবোর্ড লাগানো হলো। প্রথম লাইনের সাইনবোর্ডে লেখা, যারা বউয়ের কথা শোনেন তারা এই লাইন দাড়ান। আরেকটা যারা বউয়ের কথা শোনেন না তারা ঐ লাইনে দাড়ান। রাজ্যের সব প্রজা ঠেলাঠেলি করে যারা বউয়ের কথা শোনে সেই লাইনে গিয়ে দাড়ালো । কিন্তু বল্টু বেচারা যারা বউয়ের কথা শোনেনা সেই লাইনে গিয়ে দাড়ালো। রাজা হেরে গিয়েও একদিক থেকে খুশি হলেন, যাক রাজ্যে এক বান্দা তো আছে যে বউয়ের কথা শোনে না। তখন রাজা কৌতুহলী হয়ে বল্টুকে জিজ্ঞেস করলেন- 'কি ব্যাপার, তুমি এই লাইনে এসে দাড়ালে কেনো ? তখন বল্টু বললো- “আমার বউ আমাকে বেশি তাড়াহুড়ার মধ্যে যেতে মানা করেছে”। পেছন থেকে সুকন্যার হিহি হাসির শব্দ কানে আসলো। গল্পটি লেখার সময় সুকন্যা উঁকি দিয়ে পড়েছে।
.
৩। বাহিরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঝড়ের রাতে হরর মুভি দেখার মজাই আলাদা। আমি কুন্ডলী পাঁকিয়ে বাম পার্শ্ব বিছানায় দিয়ে মুভি দেখছি। সুকন্যা আমার ডান কান আর মাথার উপর তার মাথা রেখে সেও মুভি দেখছে। হটাৎ সুকন্যা বললো- সেদিন তোমাদের বড় বস তোমাকে আর তোমার শাখার বসকে উনার চেম্বারে তলব করলেন। তুমি যাওয়ার পর তোমার বস তোমাকে বললেন, নাবিল সাহেব, আপনি ফাইলটি আমার কাছে দেন। ঐ সময় তোমার বসকে বড় বস বললেন, হাবিব, চেয়ারে বসো। জরুরী কাজ করতে হবে। নাবিল তোমাকে চেয়ারে বসার কথা বললেন না কেন? অথচ তোমাকে তো আপনি করে সম্বোধন করা হয়েছে। আমি বললাম, এটা আমাদের অফিসের সিস্টেম। সুকন্যা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, তোমার বসের ক্ষেত্রে এটা সিস্টেম কিন্তু তোমার জন্য করুণা। আমি অবাক হয়ে বললাম- তুমি আমার অফিস সম্পর্কে জানো কিভাবে? সুকন্যা ভেংচি মেরে বললো, আমি তোমার মোবাইলে হিডেন রেকোর্ডার চালু করেছিলাম। আচ্ছা নাবিল, লাভনী মেয়েটা কে? আমি বললাম, থাক, অন্যদিন বলি। সে আনমনে মুভি দেখছে। ঘড়িতে হটাৎ ঢং ঢং শব্দ করে বারটা বাজলো। আমি কানে ফিসফিস করে বললাম- শুভ জন্মদিন সুকন্যা।
.
মিজানুর রহমান
১৭.০৩.২০১৭

পৈশাচিক আনন্দ

চলন্ত গাড়ি যেভাবে হাত ইশারা দিয়ে থামানো হয়, আমি ঢালু রাস্তায় দাড়িয়ে একই ভঙ্গিতে লোকটিকে থামার জন্য বললাম। লোকটি আমার অপরিচিত, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মাথার চুল কালো হলেও বেশিরভাগ চুল অাধপাঁকা। স্যুট টাই পরলে আধপাঁকা চুলওয়ালাদের ব্যাংকারদের মত লাগে। আমার ধারনা- স্যুট টাই পরলে এই লোককে ব্যাংকার মনে হবে না, বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী লাগবে। বিজ্ঞানীদের মত এই লোকেরও গোঁফ আছে। কালো গোঁফ। ওয়ালেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললাম- ভাই, এই টাকা একটি পার্সোনাল নম্বরে বিকাশ করতে পারবেন? সামনে বিকাশের দোকান পাবেন। মাঝে মাঝে এরকম অদ্ভুত কান্ডের মাধ্যমে আমি মানুষের উপর একধরনের সাইকোলজি প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। সেদিন ডাক বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে বললাম- আপনার দপ্তরের ই-মেইল ঠিকানা কি? নাক কপালের দিকে দ্রুত তুলতে গিয়ে চশমার ফ্রেমের ফাঁকে আটকে যাওয়ার হাল দেখে অনুভব করলাম প্রত্যেক মানুষ নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চায়। ডাক বিভাগের সংকটাপন্ন সময়ে ইমেইল ঠিকানা চাওয়াটা নিতান্ত অপমানের কাজ। 
.
রিং শুনে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি রুপা ফোন করেছে। ইদানিং আমি ওকে রুপা বলে ডাকি কেন? রুপা তো তার আকিকা করা নাম না। হুমায়ুন আহমেদ এর ধারনা- পৃথিবীর মেয়েরা রুপা আর সব ছেলেরা হিমু। আমার দৃষ্টিতে সুকন্যাকে রুপা বলে ডাকা অযৌক্তিক নয়। তবে আমি হিমু হতে নারাজ। আমি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারি না যা হিমু পারে। গত বছর ১৭ই মার্চ রাহাতকে এসএমএস দিয়ে বলি- 'তাড়াতাড়ি সুকন্যাকে ফোন করে বল- আমি হাসপাতালে, সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হয়েছি'। মিনিট খানেকের মধ্যে সুকন্যা দরজা খুলে দ্রুত বের হওয়ার সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। দরজার সামনে আমার সাথে ওর ধাক্কা লাগতেই চিৎকার না করার জন্য সুকন্যার মুখে হাত চেপে বলি- শুভ জন্মদিন সুকন্যা। এটা সারপ্রাইজ না বিভ্রান্ত করা আমি জানি না। এতোক্ষনে লোকটি গেইটের কাছাকাছি চলে গেল। বিকাশের নাম্বার নেয়নি। মানুষ যখন অলৌকিকভাবে কিছু পায় কিংবা অকল্পনীয় কিছু ঘটে তখন বিশেষ ব্যক্তিদের নাক কাঁপে। পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে লোকটির নাক কাঁপলো কিনা কিংবা অন্ধকারে ঐ দিন সুকন্যার নাক কাপলো কিনা আমার দেখা হয়নি। হাত ঘড়িতে লক্ষ করলাম সকাল সাড়ে নয়টা। দ্রুত অফিস যেতে হবে।
.
অফিসে নতুন বস জয়েন করেছেন। বস মানে মোটা পেট, কমর থেকে এক হাত উপরে চিকন বেল্ট দ্বারা শার্ট ইন আর নাগের ডগায় পাওয়ার চশমা। কিন্তু নতুন বস এরকম নয়, হালকা পাতলা গড়ন। কথার মধ্যে রহস্য রেখে কথা বলেন। আমি নতুন বসের সামনে বসা। হটাৎ বস বললেন- নাবিল সাহেব, পৈশাচিক আনন্দ বুঝেন? না বুঝলে শুনেন- রাস্তায় মজমা বসিয়ে এক লোক লেকচার দিচ্ছে- "আনোয়ারের টেস্টি হজমি, এই টেস্টি হজমি খেলে পেট ফাঁপা ভাল হয়। গ্যাসে আপনার পেট ভরে গেছে, পায়খানা কষান। পেট আপনার মোটা হয়ে গেছে? নো টেনশন! আপনার জন্য আছে আনোয়ারের টেস্টি হজমি।" আমার চোখ গেল লেকচারার এর পেটের দিকে। ইয়া মোটা পেট। আমি উনার পেটে হাত দিতেই সবাই হাসলো। বুঝলেন নাবিল সাহেব, এটাকে পৈশাচিক আনন্দ বলে। বস হুহু করে হাসছেন। আমি বললাম, দেখেন স্যার, আপনার গল্পে আমি আনন্দ নেওয়ার কিছু পাইনি। বস হুক হুক করে পানি খেলেন। আমি মৃদু হাসি দিয়ে বললাম- স্যার, এটাই পৈশাচিক আনন্দ। বস কপালের ঘাম টিস্যু দিয়ে মুছলেন। আমার নাক কাঁপতে লাগলো।
.
মিজানুর রহমান
১০.০৩.২০১৭

লক্ষ্যে যাওয়ার আর্তনাদ

সময়টা ২০১২ সালের শেষদিক। 'আমি চলে যাচ্ছি' - এটা ছিল সুকন্যার কাছে পাঠানো আমার শেষ SMS. রেল স্টেশনে সিটিং ব্যাঞ্চের এক কোনায় বসে আছি। রাত তখন গভীরের দিকে যাচ্ছে। লোডসেডিং এর কারনে ঘনঘটা অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকারা বেশ শব্দ করে ডাক শুরু করলো। মাঝে মাঝে হাত পেছনে দিয়ে মধ্য বয়সের একজন লোক আমার পাশ ঘেঁষে পায়চারী করছেন। সম্ভবতঃ আত্নহত্যা করবেন। ট্রেন আসতে নাকি রাত তিনটা বাঁজবে। 'অপেক্ষার চেয়ে মৃত্যু ভাল' কথিত সাজেশনসটা এক্ষেত্রে বড্ড বেমানান। মরতে গেলেও অপেক্ষা করতে হয়। আমরা ট্রেনের অপেক্ষায় আছি...
.
শুনেছি গভীর রাতে প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে। আমারও সুকন্যার কথা খুব মনে পড়ছে। সুকন্যা আর আমি একসাথে হাইস্কুলে পড়েছি। সঙ্গত কারনে আমাদের মাধ্যমিকের ব্যাপ্তিতে কখনও কথা বলার সুযোগটা হয়নি। মনে আছে মোবাইল কিনে প্রথম কলটা সুকন্যার মায়ের নাম্বারে দিয়েছিলাম। আমি হ্যালো বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে কড়া নির্দেশনা- 'আর যদি এই নাম্বারে কল আসবে আমি তোমার নাক কেটে দিবো' আমি স্পষ্ট বুঝলাম গলাটা সুকন্যার ছিল। এই প্রথম সুকন্যার সাথে আমার কথা হয়েছে। একটা সময় ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়। আমরা এখন কথা না বলে থাকতে পারি না। গেল ভালবাসা দিবসে সুকন্যাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঐদিন আমার নাক কাটার হুমকি কেন দিয়েছিলে? কোন উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলো, কিছু বললো না। ছেলেদের নাক হয়তো মেয়েদের কাবু করার মারণাস্ত্র, নইলে সুকন্যা আমার নাক কাটতে চাইলো কেন? স্টেশনে বসে আমিও মৃদু হাসলাম। স্মৃতি শুধু কাঁদায় না, হাসাতেও পারে।
.
রাত সাড়ে তিনটা। আমি ট্রেনের জানালার পাশে বসে আছি। ট্রেন শব্দ করে চলছে। এক পালি ধমকা হাওয়া ধাক্কা দিয়ে চোখের ঘুম কেঁড়ে নিলো। মোবাইল হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করলাম। সুকন্যা রাতে একবারও কল করেনি। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। মাথা ডান কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, ঘুম আসছে না। গান শুনতে ইচ্ছে করছে। বাপ্পা দার 'পরী' গানটা আমার খুব প্রিয়। শীতের দিনে বৃষ্টির গান শুনতে মন চায় কেন? মানুষের চাহিদা অদ্ভুত! সুকন্যার ব্যাপারটাই এরকম। অনার্সে পড়ুয়া বেকার এই আমাকে ভালবাসে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। আমার প্রাসাদ নেই। থাকার জায়গা নেই। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি। তবুও সুকন্যা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।
.
ট্রেন চলছে। মাথায় হালকা ব্যথা করছে। ফেসবুকে লগ ইন করতেই নিউজফিডে জনপ্রিয় নির্মাতা রেদোয়ান রনির স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার গল্পটা শুনতে চান রনি ভাই। একজন লিখেছেন- 'কলেজে সুমির সাথে আমার পরিচয়। ভালই চলছিলো। এখন আমি ওর বাচ্চার মামা। ওর বাচ্চা ছাত্র, আমি এখনও ছাত্র। সব ইতিহাস।' কয়েকটি কমেন্ট পড়লাম। হোমপেজে আবার ফিরে গেলাম। ক্রল টানছি.... আরেকটি স্ট্যাটাসে চোখ পড়লো। একজন ভদ্রলোক লিখেছেন- 'কিভাবে ওজন আর মেদ কমাবো?' আমি কমেন্টে লিখলাম সকালে ঘুম থেকে ওঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে আশেপাশে কোন লীগের অফিসে গিয়ে বলবেন, ব্রাদার নিকটস্থ ধানের শীষের অফিসটা কোনদিকে? ওজন আর মেদ কমানোর বাকি দায়িত্ব ওদের। হটাৎ ট্রেন থেমে গেল। ক্রসিং হবে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখি মিটমিট আলো জ্বলছে। জোনাকিরা নিখুঁতভাবে প্রকৃতিকে সাজিয়েছে। খুব ক্লান্তি আসছে। চোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে। ট্রেনে যে কয়েকদিন ঘুমিয়েছি, খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। ঘুমের মাঝে সুকন্যা যদি হারানোর ভয় দেখায়, আমার বেকারত্বকে দায়ী করে! হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন আবার যাত্রা শুরু করলো। ট্রেনের সবাই ঘুমাচ্ছে। ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের দিকে আর আমি এগুচ্ছি সম্ভাবনা আর প্রতিশ্রুতির দিকে....
.
মিজানুর রহমান
১৮.০২.২০১৭

সাদা আর নীলের হৃদয়তা

মুন্নিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মোবাইলে অফিস থেকে ফোন আসলো। বসের ফোন। মোস্ট প্রায়োরিটি টু বস। এই সময় বউকে বিবেচনা করা মানে বালুর দুর্গ ভেঙ্গে দেওয়া। সেকেন্ড অপচয় না করে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই গাম্ভীর্যভাব গলার আওয়াজ। শুনেছি এই আওয়াজ বস হওয়ার আগে শিখতে হয়, চর্চা করতে হয়। এক্ষেত্রে বসকে শতভাগ সফল বলা উচিত।
.
সাদা পাঞ্জাবি গা থেকে রেখে ফরমাল ড্রেস পরে নাবিল বাসা থেকে বের হয়ে হাটছে, রাস্তায় রিক্সা নেই। ইদানিং রিক্সাওয়ালারা শুক্রবার ছুটিতে থাকে। আয়েশ করে। কিন্তু নাবিলরা পারেনা। প্ল্যান ছিল, এই শুক্রবারে ঘুরতে বের হবে। খুব ইচ্ছে ছিল ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে লেকের পাড়ে মুন্নির হাত ধরে হাটবে। মুন্নির পরনে থাকবে নীল শাড়ি আর হাত পর্যন্ত আবৃত সাদা ব্লাউজ। খোলা চুল লেকের বাতাসে যখন দোল খাবে নাবিলের চোখ পড়বে মুন্নির ঠোঁটের নিচে কালো তিলের দিকে। কি আর করার? মোস্ট প্রায়োরিটি টু বস। 
.
কম্পিউটার ডেস্কে নাবিল বসে আছে, বস চেয়ারে বসে ডানে বামে মুভ করছেন। কি যেন ভাবছেন? ছুটির দিনের অফিসের বসরা অন্যরকম হয়। অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর ব্যতিক্রম ফিলোসপি প্রয়োগ করেন। কর্মচারীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে ঢুঁ মারেন, ভাল মন্দ জানেন। নাবিলের ক্ষেত্রেও তাই হলো। নাবিলের মন খারাপ বস টের পেলেন।
.
- নাবিল সাহেব দেখেন, সবাই কিন্তু বাসায় আয়েশ করছে। অথচ আপনি আর আমি এখন অফিসে। ওদের দেশপ্রেম নেই। আমরা দেশের জন্য কাজ করছি, দেশের পরিবর্তন চাচ্ছি। আপনি আর আমি ছাড়া অফিসের সব কয়টা ছাগল, কি বলেন?
- কিভাবে স্যার?
.
- ছাগলের স্বভাব জানেন? না জানলে শুনেন- মাঠে যখন ছাগল ঘাস খেতে যায়, একা একা থাকে, দলবদ্ধ থাকে না। আপনি চাইলেও এদেরকে একসাথে রাখতে পারবেন না। এই যে আমাদের অফিস, কারো কোন দায়িত্ব নেই। সবাই একা একা থাকে। বুঝলেন? 
.
- বুঝলাম স্যার। আপনার কথা ঠিক। ভেড়ার কথা মনে পড়ে গেল স্যার। ভেড়ার বৈশিষ্ট হয়তো আপনি জানেন স্যার। এরা দলবদ্ধ হয়ে ঘাস খায়। সুখে দুঃখে এরা একসাথে থাকে। ছুটির দিনে আপনি আর আমি অফিসে কাজ করছি, একসাথে আছি। আমরা তাহলে ভেড়ার দলে, কি বলেন স্যার?
.
- উই শোড এভোয়েড ফালতু টক, আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। সময় নষ্ট করা একদম ঠিক হবে না। কনসানট্রেট টু ওয়ার্ক। নাবিল সাহেব ডেস্কটপে একটি ডক ফাইল খুলেন।
.
- কি নামে ক্রিয়েট করবো স্যার? 
.
- 'জিএম ভাবী' নামে ক্রিয়েট করেন। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বাণী লিখতে হবে। কোনটা রেখে কোনটা করি? এতো কাজ, আর পারছি না। নাবিল সাহেব, ওয়েট... জিএম স্যার ফোন দিয়েছেন। আপনি বরং মাসিক সভার চিঠিটা ড্রাফট করুন, ওকে।
.
নাবিল কি-বোর্ডে টপটপ করে চিঠি ড্রাফট করছে। বস জিএম স্যারের সাথে কথা বলছেন। এক হাত দিয়ে পেপার ওয়েট লাটিমের মত ঘুরাচ্ছেন আর জিএম স্যারকে প্রয়োজনের অধিক স্যার স্যার বলে কাজ বুঝে নিচ্ছেন। বস এতো দ্রুত স্যার বলছেন উচ্চারণটা ষাঁড় ষাঁড় এর মত নাবিলের কানে আসছে। নাবিল হতাশার মৃদু হাসি নিরবে হাসলো। বসের কথা শেষ। বস বিরক্ত স্বরে নাবিলকে বললেন- 
.
- নাবিল সাহেব, জিএম ভাবীর ভেতরে ঢুকেন। 
- কি যে বলেন স্যার? 
- আরে.... ঐ যে... ওই ফাইলটা যেটাতে আমরা বাণী লিখবো।
.
কি-বোর্ডে আবার টপটপ শব্দ শুরু হলো। বসের মগজ থেকে যা বের হচ্ছে নাবিল তা টাইপ করছে.... অকর্মের কর্ম। নাবিলের ফোনে কল আসছে, সম্ভবতঃ মুন্নির ফোন। ভাইব্রেসন দেওয়া। নাবিল কল ধরছে না। কাজে বিঘ্ন হচ্ছে দেখে নাবিল মোবাইল পুরোদমে সাইলেন্ট করে দিলো। মোস্ট প্রায়োরিটি টু বস। রাত অবধি নাবিল অফিসে ছিল। দেশের জন্য কাজ করলো। বস'রা শনিবার বুঝে না, ছুটি বুঝে না। নাবিলরা চাপা স্বভাবের হয়। নাবিলের নিজের বিয়ের ১ম বার্ষিকী বিসর্জন দেয় বস জানেনা। বস বড় বসকে সন্তুষ্ট করে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে আর নাবিল ফিরে এক রাস হতাশা নিয়ে।
.
মিজানুর রহমান
০৩.০২.২০১৭

২১ শে ফেব্রুয়ারি ও বর্তমান সময়ের ভাষা চর্চা

বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তরুন রাজনীতিবিদ জনাব নাহিম রাজ্জাক মহোদয়ের নেতৃত্বে কিছু উদ্যোমী তরুণরা গত ১৫ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে 'ইয়ং বাংলা' নামে একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু করেন। পরের বছর ৩১ জানুয়ারি এম.সি কলেজে সংগঠনটির সিলেট অংশের বিভাগীয় Meet অনুষ্ঠিত হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সিলেটের একজন তরুন উদ্যোক্তা তার বক্তব্যে বাংলাদেশকে 'ভাংলাদেশ' বলে উচ্চারণ করা শুনে আমি স্তব্দ হয়ে যাই। একজন সচেতন বাঙ্গালী নিজের দেশের নামের উচ্চারণ সঠিকভাবে বলতে পারেনা। এটা বাঙ্গালী জাতি হিসেবে খুবই লজ্জার ব্যাপার। আমার ভেতর তখন অপরাধবোধ কাজ করে।
.
পৃথিবীর কোন জাতির ইতিহাসে ভাষা নিয়ে আন্দোলন, ভাষার প্রতি জীবন উৎসর্গের রক্তিম পরিস্থিতি কখনও ঘটেনি। আমাদের ভাষা রক্ষার আত্নত্যাগের ইতিহাস আছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই আমরা ভাষার প্রতি মমতা দেখাই। ভাষা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের অজ্ঞতার কথা বলি। খুব দুঃখ হয় যখন দেখি সিলেটে ভাষা চর্চার কোন মানসম্মত প্লাটফর্ম নেই। এখানকার ছেলে মেয়েরা ভুল বাংলা শিখছে, ভুল বানানে নিজেকে সমৃদ্ধ করছে। আমি নিজেও বাংলা ভাষার সঠিক চর্চার ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছি। নিজের অজান্তে প্রতিনিয়ত ভুল বানানে লিখছি, ভুল উচ্চারণ করছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যদি সপ্তাহে অন্ততঃ দুই দিন ভ্রাম্যমান ট্রেনিং বাসের মাধ্যম বাংলা ভাষা চর্চার ক্লাস নেওয়া হয় এদেশের ছেলে মেয়েরা শুদ্ধ বাংলাকে জানবে। শুদ্ধ বাংলার জয়গান করবে।
.
সেদিন পত্রিকায় দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রাম এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের CSE বিভাগ শিক্ষার্থীদের বানান ভীতি দূর করতে 'শব্দকল্পদ্রুম' নামে একটি উৎসবের আয়োজন করতে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি বিভাগীয় জেলায় এই উৎসব আয়োজন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৩ মার্চ ২০১৭ তারিখে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে বিভাগীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় এ উৎসব আয়োজনের কথা রয়েছে। যদি আজ উৎসবটি সারাদেশে বিভিন্ন শহিদমিনারে একযোগে আয়োজন করা হতো সকলের নিকট এ উৎসবের গ্রহণযোগ্যতা পেত শতভাগ।
.
মিজানুর রহমান
২১.০২.২০১৭

একটি চিরকুট ও প্রকৃতির মানবতা

- বুঝলেন সাহেদ, এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। আর ঐ যে দেখছেন ব্রীজটা, এটা সিলেটকে হাইলাইট করে আর এইটা হলো আলী আমজাদের ঘড়ি। সুন্দর না?
.
দীর্ঘ স্বরের 'হুম' শব্দ শুনে আমি ফিরে তাকাতেই দেখি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক। দাঁড়ি কৃষ্ণকায় বর্ণের। দেখলেই মনে হয় বয়স ২৭-২৮ হবে। করমর্দনের জন্য আমার দিকে এগিয়ে এসে পাঞ্জাবি পরা লোকটি বললেন- 'আমি সাহেদ। যদি ভুল না করি তবে আপনি নাবিল, তাইতো? প্রীতির মুখে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।' আমি হাত না ছেড়ে প্রীতি নামের মেয়েটির দিকে একবার আর পাঞ্জাবি পরা লোকটির দিকে একবার এভাবে তাকাচ্ছি। প্রীতিই তো! হাত ছেড়ে আমার সেই বিখ্যাত ঠোঁট টিপা হাসি দিয়ে বললাম- 
- জ্বী আমি নাবিল। বসেন সাহেদ সাহেব।
.
- ওকে। তবে আমি বসবো না। প্রীতি তুমি বসো। আমি হেঁটে ওদিকটা একটু দেখি।
.
একজন হুজুর টাইপের লোক অথচ নিজের স্ত্রীকে আমার পাশে রেখে একা হাটছেন...। আমি প্রীতির পাশে শহরের জিরো পয়েন্টে চায়ের দোকানে বসে আছি। নদীর পাড়ের হিমেল বাতাস আর মাঝারি ঢেউয়ের কলকল শব্দ শুনে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। দীর্ঘ চার বছর পর প্রীতির সাথে আবার দেখা হবে বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কয়েকদিনে প্রীতি অনেক বদলে গেছে। আমি যে প্রীতিকে চিনি তার আগুন রঙ্গা ঠোঁটের নিচে ছিল একটি কালো তিল আর চেহারা ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা। খোপা খোলা চুল ছিল। অথচ এই প্রীতির তিল নেই, চেহারাও বেশ ফর্সা, হিজাব করা। মেকআপ করেছে কিনা কে জানে! আমাদের বাসা ছিল একই ফ্লাটে। প্রীতির বাবা আমাদের ভার্সিটির ভিসি ছিলেন। প্রীতি আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। সেই সূত্রে প্রীতির সাথে পরিচয়। চায়ের কাপ রেখে আমি প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললাম-
- বুঝলে প্রীতি, এই যান্ত্রিক শহরে স্রেফ একা থাকা খুব কঠিন। চাইলেই তুমি একা থাকতে পারবে না।
.
- হুম। শুনলাম বিয়ে করেছো। সংসার নিয়ে ভালই আছো, তোমার কথা বলার ধরন দেখে তাইতো মনে হচ্ছে।
.
- ভালই কথা শিখেছো। প্রীতি, সাহেদ সাহেবকে আমার বিষয়ে কি গল্প করেছো, একটু কি বলবে....?
.
- নাক চেপ্টা বেটা, তুমি এমন বিখ্যাত কেউ না যে তোমার কথা গল্প করবো। গল্পটল্প করিনি। বিয়ের রাতের তোমার ঘটানো কান্ডটা স্যায়ার করেছি।
.
সেদিন ছিল ২২ শে শ্রাবণ। প্রীতির বিয়ের আগের রাত। এতোক্ষনে গায়ে হলুদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমি রুমে বসে আছি। প্রীতি বারবার ফোন করছে। আমি কল ধরছি না। এই প্রথম প্রীতির জন্য শূণ্যতা অনুভব করছি। এই শূণ্যতা প্রীতির জানার অধিকার নেই। আমি যদি গায়েহলুদে না যাই প্রীতি রুমে এসে খুঁজবে। প্রীতির পাশে দাড়ানোর শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমি কাউকে না বলে কিছু কাপড় আর বই নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। রাতটা রাফির বাসায় কাটাবো। রাফির বাসায় আসার পর দেখি ডায়েরি আনিনি। সম্ভবতঃ পড়ার টেবিলে রেখে এসেছি। মনে আছে, শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম- প্রীতি নামের মেয়েরা এতো চাপা স্বভাব হয় কেন? 
 .
ডায়েরি অথবা বিয়েতে না যাওয়া, কোনটি প্রীতির ভাষায় কান্ড... কে জানে? চোখের সামনে প্রীতির হাত নাড়ানোর কারনে আমার অবচেতন মন পুনরায় জাগ্রত হলো। আমি বললাম-
- কি যেন বলেছিলে?
.
- বলেছি বিয়েতে গেলে না কেন? অবশ্যই আমি খালেদকে বিয়ে করিনি :)। রাতে আমার এক বান্ধবী খালেদ যে ড্রাগ এডিকটেড ছিল এই বিষয়ে বাবাকে বেশ কিছু ভিডিও দেখিয়েছিল। এই কারনে বাবা বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন।
.
- মানে? তাহলে আসাদ সাহেব! কিছুই মাথায় যাচ্ছে না। ক্লিয়ার করো।
.
- উনি আমার বোনের স্বামী। তুমি আপার বিষয়ে কিছু জানো না?
.
- না।
.
- আপা গত বছর বাচ্চা প্রসবের সময় মারা গেছেন। আমার কোলের বেবিটা আপার। বউহারা বেচারা বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রামে বিপদে আছে। মানুষটার জন্য মায়া হয়। তাই ভাবলাম সিলেটে নিয়ে আসি। একটু ঘুরিয়ে দেখালে হয়তো ভাল লাগবে মানুষটার।
.
প্রীতি আমার ডানপাশে বেঞ্চে হাত ভর করে নীল আকাশ দেখছে। আমি পকেট থেকে কলম বের করে কুড়িয়ে নেয়া কাগজে বড় করে লিখলাম- "এই নাক চেপ্টা বেটার হাতের উপরে চাপা প্রীতির হাতটা রাখা যাবে?" আমি হাতটা প্রীতির পাশে রাখলাম। ফাঁকা স্থানে চিরকুট। আসাদ সাহেবও আমাদের দিকে ফিরে আসতেছেন। হটাৎ একটা ধমকা হাওয়া এসে চিরকুট উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি প্রীতির চোখের দিকে থাকালাম। আমার হৃদকম্পন বাড়তে লাগলো। আমি এই প্রথম রহস্যে ডুব দিলাম। আমার ভেতর প্রীতি নামে নতুন মৌন মিছিল আন্দোলিত হলো। আমি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। মানবিক বিস্ময় আমাকে ভাবাতে শুরু করলো। আসাদ সাহেব প্রীতিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি আনমনে প্রীতির প্রস্থান দেখছি... কানের কাছে এক অদৃশ্য শব্দ ফিসফিস করে বলতে লাগলো- প্রীতি আছে, প্রীতি থাকবে। 
.
মিজানুর রহমান
০১.০৫.২০১৭

একটি মূল্যবোধের গল্প

গেল বিজয় দিবসের ঘটনা। নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে আমি সালাম গ্রহণ মঞ্চের পেছনে দাড়িয়ে ছিলাম। ততক্ষণে পতাকা উত্তোলণসহ কুচকাওয়াজের মত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ডিসপ্লে প্রদশর্নী, খেলাধুলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে। সালাম গ্রহণ মঞ্চে যারা ছিলেন তারাও নেমে গেছেন। আমি তখনও দাড়িয়ে আছি। ঐ অবস্থান থেকে ভালোভাবে মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে দেখা যাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের শিশু পরিবার খুব ভাল পারফর্ম করছে সেটা দেখছি। হটাৎ কয়েকটি গলার আওয়াজ শুনে মনোযোগ সালাম গ্রহণ মঞের দিকে গেল। একটি শিশু মঞ্চের সামনের অংশে ঠিক মাঝামাঝি বসে পা ঝুলাচ্ছে। মঞ্চটি একটু উচু হওয়ায় দূর্ঘটনা এড়াতে আমরা কয়েকজন ছেলেটি নামানোর জন্য তার কাছে গেলাম। কোনভাবেই তাকে নামাতে পারছি না। সে নামতে চায় না। এক পর্যায়ে বললাম- বাবু, এখানে থেকে তোমার লাভ কি, নেমে যাও, বিপদ হতে পারে। ছেলেটির চেহারায় বিরক্তের আবহ লক্ষ করলাম। আবারও বললাম- বাবু নেমে যাও। আমার হাতটাসহ আমাকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে উচ্চ স্বরে বললো- আমার বাবা Rank পাইছে, আমার এখানেই বসা ঠিক আছে। আমি এখানেই বসবো। আমরা স্তব্দ হয়ে গেলাম। পেশীর সব শক্তি হারিয়ে ফেললাম। বাবুটা সামনে বসে আছে আর আমি পেছনে দাড়ানো। নৈতিক অধঃপতন!
.
গল্পটি আজ স্যায়ার করছি বিভিন্ন কারনে। মাতৃগর্ভে জন্ম নিলেই একটি শিশু মানুষ হয়ে ওঠে না, মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় পরিবার। শিশু যা দেখে তাই শেখে আর এভাবে শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এই জায়গায় পরিবারের বাবা-মায়েরা কতটুকু দায়িত্ব নেয় তা নিজের মধ্যে সংশয়ের উদ্ভব হয়। কথাটা বলার পেছনে কারন আছে। যে ছেলে বাবার Rank পাওয়া নিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করে সে পরিবার থেকে কি শিখেছে বলা বাহুল্য। সে যদি জানতো, তার বাবা আততায়ীর হাতে খুন হওয়া এক সন্তানের পিতার সার্বিক নিরাপত্তাসহ আসল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার সাফল্যের জন্য এই Rank বা প্রমোশন পেয়েছেন। তার ভেতর এক ধরনের মূল্যবোধ জাগ্রত হতো। এই মূল্যবোধ বিকৃতির দায় শিশুর চেয়ে তার পরিবারের বেশী। মা বাবা দুই দপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্ব স্ব দপ্তরে সর্বোচ্চটা দেওয়াতে যখন তারা মগ্ন, ছেলের লালন পালনের দায়িত্ব পড়ে অশিক্ষিত গৃহকর্মীর হাতে। স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে বাবার মত সামনের চেয়ারে বসবে, সবাই প্রটোকল দিবে, তোষামোদ করবে। সাধারন মানুষের জীবন সম্পর্কে সে জানেনা, দরিদ্রের দুর্দশা কখনও সে দেখেনি। পারিবারিক মূল্যবোধ সে পায়নি। দেশপ্রেম সম্পর্কে তাকে কেউ উদ্বুদ্ধ করেনি। পারিবারিক বন্ধন থেকে সে বঞ্চিত। দিন শেষে অফিসটাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাসায়। সে অফিসকে জানে, বাবার Rank কে জানে, বড় হয়ে বাবার মত ক্ষমতাধর হওয়ার প্রেষণা শুনে। বিভিন্ন উপলক্ষতে সামনে চেয়ারে বসে, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সে ডুব দেয় বড় হওয়ার সমুদ্রে। মানবতা, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অধঃপতন হয় তার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে। সময়ের কারনে তিনি দাড়িয়ে থাকবেন সালাম গ্রহণ মঞ্চে আর আমি থাকবো পেছনে... অনেক পেছনে।
.
মিজানুর রহমান
২১.০১.২০১৭ খ্রি.

তৃপ্তির অতৃপ্ততা

আমি প্যান্টের পকেটে হাত রেখে শহরের ছোট গলি দিয়ে হাঁটছি। চৈত্র মাসে পিচগলা রোদ থাকার কথা অথচ আকাশে কালো মেঘ। পকেটে হাত রাখার কারন হিম শীতল বাতাস বইছে। সময় জানাটা খুব দরকার। আমার সামনের লোকটিকে যদি জিজ্ঞেস করি- 'এই যে ভাই, কয়টা বাঁজে?' পকেট থেকে মোবাইল বের করে মৃদু হাসি দিয়ে বলবে- সকাল দশটা। কিন্তু তিনি তা না করে সময় দেখলেন হাতঘড়িতে। এ যুগের বেশীরভাগ ছেলেরা হাতে ঘড়ি থাকা সত্ত্বেও সময় দেখে মোবাইলে। ঘড়িটা ফ্যাশন। আমি হাঁটছি। বসন্তকাল প্রায় মাঝামাঝি অথচ এখনও শীতের ঘোর কাটেনি। এটা আমার বয়সে দেখা প্রথম শীতের বসন্ত। জনসম্মুখে নিজের বয়সকে সম্পৃক্ত করে কথা বলার ক্ষেত্রে আমি ইদানিং খুব সচেতন। একবার দিপু স্যারের কোচিং ক্লাসে কি কারনে কনফিডেন্ট নিয়ে বলেছিলাম - আমার বয়সেও এটা দেখিনি। স্যার কপালে ভাঁজ ফেলে বলেছিলেন- 'তোমার আগে কলাগাছ ফল দেয় মিয়া, রাখো তোমার বয়স'। ঐ দিনে মহিলা সহপাঠীদের বিরামহীন হাসিটা আমাকে এখনও অপমানের পীড়া দেয়। আমি ফোঁপানি টাইপের শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছি তখনই বৃষ্টি শুরু হলো। মুষলধারে বৃষ্টি। চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি। এই যান্ত্রিক শহরে সবার আচরণ এই মুহুর্তে এক। কেউ ভিঁজতে চায় না। সবার চোখ আমার ছাতার দিকে। মাঝে মাঝে ভিন্ন হতে ভাল লাগে। আমি ছাতা উপরের দিকে ছুঁড়ে বৃষ্টিতে ভিঁজবো এই প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন পাশ ঘেঁষে একটি রিক্সা থামলো। রিক্সাওয়ালা বেল টিপে আমার মনযোগ আকর্ষণ করতেই দেখি সুকন্যা রিক্সায় বসা। আমি ওকে সুকন্যা নামে ডাকলেও তার ভাল নাম সাবিলা জাফরিন। আমি না চেনার ভান করে দ্রুত প্রস্থানের চেষ্টা করছি তখনই সুকন্যার 'নাবিল, এই নাবিল' ডাকে থামতে বাধ্য হলাম। আমি ঠোঁট টিপে মৃদু হাসি দেয়ার চেষ্টা করে বললাম- কেমন আছিস? সুকন্যা গলার স্বর বাড়িয়ে বললো- 'তুই দাড়িয়ে কথা বলবে, রিক্সায় ওঠ্।
.
বিরামহীন বৃষ্টি বর্ষণেও রিক্সা চলছে। আপাতত গন্তব্য কোথায় জানিনা। সুকন্যাকে একবার বলা দরকার 'আমরা তাহলে যাচ্ছি কোথায়?' তবে এখন বলা যাবে না। আপাতত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। শহরে ইদানিং বিলবোর্ডের পরিমান বেড়েছে। আমি একটি বড় বিলবোর্ডে লক্ষ স্থির করলাম। কয়েক বছর আগেও এই বিলবোর্ডে বিয়ারিং এর বিজ্ঞাপন ছিল। এখন অাকর্ষণীয় গাড়ির বিজ্ঞাপন। দেশে উন্নতির পথে যাচ্ছে এই বিজ্ঞাপন দেখে তাই মনে হচ্ছে। রিক্সাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত কিন্তু ইস্যু পাচ্ছি না। বেচারা মাথা একটু নুইয়ে প্যাডেল মারছে। বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। সুকন্যার দিকে তাকাবো ভাবছি তখনই সে আমার দিকে তাকিয়েই রিক্সার হুড ফেলে দিলো। সুকন্যার গায়ে গাঁঢ় বেগুনী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা খোলা চুল। বৃষ্টির দিনে গাঁঢ় বেগুনী শাড়ি আর ভেঁজা চুলে মেয়েদের এতো সুন্দর লাগে সুকন্যাকে দেখে প্রথম উপলব্দি করলাম। এতো বৃষ্টিতে হটাৎ হুড ফেলার কারন বৃষ্টিস্নান নাকি রিক্সাওয়ালার প্রতি তার সহমর্মিতা কে জানে? অনেক পথ এসে গেলাম অথচ সুকন্যা কোন কথা বলেনি।
- কিরে, রিক্সায় তুলে খুব মুডি হয়ে গেলে নাকি? কোন কথা বলছিস না যে?
- তোর মোবাইল দেয় তো। বাসায় একটা কল করবো। আমার মোবাইলে চার্জ নাই।
ফোনে কথা শেষ হতেই সুকন্যাকে ফের প্রশ্ন-
- তোর আর খবর কি? পড়াশোনার কি অবস্থা? থাকিস কোথায়? সেই ইন্টারমিডিয়েট পর তোর সাথে প্রথম দেখা।
- তুই এখনো বদলালে না নাবিল! এখনও এতো প্রশ্ন এক সাথে করার অভ্যাস তোর আছে! বাদ দে, তোর খবর কি? পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করছিস নাকি?
- আছি এইতো একটা অফিসে।
- এই মামা থামান তো। নাবিল, আমি তাহলে যাই। ভাল থাকিস।
.
সুকন্যার সাথে ইদানিং ফোনে ঘনঘন কথা হচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ফোনে অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন করে। আজ জিজ্ঞেস করলো- 'নাবিল, মিস করা আর ফিল করা কি এক?' তার প্রশ্ন শুনে আমার ভেতর এক অজানা কৌতুহল তৈরি হলো। মেয়েরা প্রেমে পড়লে মিস আর ফিল করার মধ্যে মিল-অমিল খুঁজে। সুকন্যা কি কারো প্রেমে পড়েছে, কে জানে?
.
আমি সিএনজির পেছনে বামপাশে বসে আছি। ট্রাফিক জ্যাম ছাড়তে আধাঘন্টা লাগবে। পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছি। প্রথম পাতায় দেখলাম বড় করে শিরোনাম- বাবার পেশাগত পরিচয় ম্যাজিস্ট্রেট আফরোজার অকাল মৃত্যু!! বিস্তারিত পড়তে গিয়ে গা শিওরে উঠলো। আফরোজা বাবা ডিসি অফিসের অফিস সহকারী এই বিষয় ছেলে পক্ষ জানতে পেরে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। অাফরোজা অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যা করেছে। আমি মোবাইল বের করে সময় দেখবো তখন দেখি সুকন্যা এসএমএস করেছে। এবারের ৩৫ তম বিসিএস এ সে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছে। মোবাইল পুরোদমে অফ করে লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। ৮ বছরের একটি শিশু ফুল কেনার জন্য বিরক্ত করছে। কিছু বলতে পারছি না। পথ শিশুদের জন্য মায়া হয়। আমি কয়েকটি গোলাপ কিনে হাতে নিলাম। এতোক্ষণে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। সামনের কোন অস্থায়ী ডাস্টবিনে গোলাপগুলো ফেলে দিবো... ফুল আমার জন্য নয়।
.
মিজানুর রহমান
০৬.০৪.২০১৭